অরিত্রী,
শিশিরভেজা শীতের সতেজ সকালের
মতো তোমাকে একটা তাজা খবর শোনাই। আত্মহত্যার খবর। আত্মহননের সংবাদ। সংবাদটা হলো- আজকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের রাজু নামের এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছে।
জানো অরিত্রী, সমাজবিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির ক্যান্টিনে দূর্দান্ত রকমের একটা খিঁচুড়ি পাওয়া যায়। যখন আমি চবির ছাত্র ছিলাম, তখন বন্ধুদের নিয়ে দলবেঁধে সেই খিঁচুড়ি খেতে যেতাম। খিঁচুড়ি খেতে খেতে কতো আলাপ করে এসেছি সেই ক্যান্টিনে! রাজু নামের যে ছেলেটা আজ আত্মহত্যা করেছে, সেও নিশ্চয়ই এই খিঁচুড়ি খেতে খেতে সাজিয়েছিলো তার জীবনের আলপনা। এঁকেছিলো জীবনের পরিকল্পনা। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস দেখো, তার জীবনের সকল আলপনা, জল্পনা আর পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ লাভ করবার আগেই সে নিজেই অতীত হয়ে গেলো।
আচ্ছা অরিত্রী, সে কি আগাম বুঝতে পেরেছিলো যে এই দেশে, এই সমাজে তার স্বপ্নগুলো কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে? সে কি বুঝে গিয়েছিলো তার জীবনের স্বপ্নগুলো দিবারাত্রির স্বপ্নের মতো, ঘুম ভাঙলেই মিলিয়ে যায়?
অরিত্রী, তোমাকে শোনাবার মতো আমার কাছে আরো সংবাদ আছে। আত্মহত্যার সংবাদ। এইতো সপ্তাহখানেক আগে, ঢাবিতে আত্মহত্যা করে বসলো হুজাইফা নামের আরেক ছাত্র। একেবারে তাগড়া জোয়ান। শুধু হুজাইফাই নয়, গত একমাসে ঢাবিতে আত্মহত্যা করেছে আরো সাতজন ছাত্রছাত্রী। ওরাও তোমার মতো। ভালো জায়গায় পড়তে এসেছিলো ভালো কিছু করার আশায়। ভালো কিছু হবার আশায়....
কিন্তু.... তুমি কি জানো কেনো ওরা এভাবে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ? কেনো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে আত্মহননের মাধ্যমে আত্মবিধ্বংসী লাশের সারি?
ওদেরকে বলা হয়েছিলো একটি সুন্দর জীবনের কথা। একটি সুন্দর ক্যারিয়ারের কথা। বলা হয়েছিলো, ঢাবি ক্যাম্পাসে পা দিতে পারলেই বাকি জীবন ফকফকে পরিষ্কার। ঢাবিতে পড়তে পারলেই ক্যারিয়ার হয়ে যাবে। পড়াশুনা শেষ করবার আগেই চাকরি এসে পায়ের কাছে ঘুরঘুর করবে। বলা হয়েছিলো- ঢাবিতে পড়তে পারাটাই গৌরবের। প্রেস্টিজের।
বলা হয়েছিলো, চবির অর্থনীতির ডক্টর ইউনুস আজ সারা বিশ্বের আইকন। তাহলে, তুমি কেনো নও? এসো! আইকনিক জায়গায় তুমিও দুনিয়া কাঁপাও।
চারদিক থেকে এতো এতো আশা-ভরসার বাণী আর স্বপ্নের কথা শুনতে শুনতে ওরাও ভেবেছিলো জীবনটা বোধকরি একেবারেই জলবৎ তরলং। খালি, ভালো জায়গায় ভর্তি হতে পারলেই কেল্লাফতে। কিন্তু, সময়ের সাথে সাথে ওরা বুঝতে পারলো জীবনটা আসলে রেল লাইনের মতো সমান্তরাল নয়। ওরা জানতে পারলো, যারা তাদের এতোদিন স্বপ্নের গল্প শুনিয়েছে, তারা একেকজন মিথ্যাবাদী রাখালের মতোই। মিথ্যুক।
এই ছেলেমেয়েগুলো যখন দেখলো যে গ্র্যাজুয়েশান শেষ করেও তাদের ঝলমলে স্বপ্নের সবটা জুড়ে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার- তখন এরা হাল ছেড়ে দেয়। এরা বুঝলো, এখানে মেধাই সবকিছু নয়, ক্ষমতাই সবকিছু। ওরা যখন দেখলো ওদের স্বপ্নগুলো পিষে মরছে 'কোটা' নামক যন্ত্রের নিচে, যখন দেখলো দালালিপনা, ঘুষ আর নোংরা রাজনীতি গলা টিপে হত্যা করে দিচ্ছে তাদের সাজানো, অঙ্কিত আর পরিকল্পিত স্বপ্নগুলোকে, তখনই এরা বেছে নেয় আত্মহননের পথ। যে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে তারা ক্যাম্পাসে আসে, নিষ্ঠুরভাবে সেটাকে ধ্বংস হতে দেখে তারা নিজেকেই আত্মহুতি দেয়। ওরা আসলে মরে গিয়ে বেঁচে যেতে চায়।
অরিত্রী, তুমি তোমার অপমানটা নিতে পারোনি। এজন্যেই তুমি আত্মহত্যা করে অপমানের শোধ নিয়েছো। কিন্তু, যে শিক্ষাব্যবস্থা রোজ রোজ, প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন আমাদের অপমান করে চলেছে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কোন প্রতিশোধ আমরা নিতে পারিনা। চোখ মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হয়। ওরা আমাদের প্রশ্ন ফাঁস করে অপমান করে। ওরা আমাদের চাকরির বাজারে অপমান করে। ওরা আমাদের কোটা পদ্ধতির নামে অপমান করে। আমাদের অপমান করে ভুল শিক্ষা, ভুল স্বপ্ন আর ভুল জীবনের পাঠ দিয়ে।
তুমি তোমার শিক্ষকের কাছে ওই একবারই অপমানিত হয়েছিলে। কিন্তু, আমরা পুরো পৃথিবীর কাছেই অপমানিত হই। সিজিপিএ'র মোটা মোটা সার্টিফিকেট বগল বাঁধাই করে যখন একটা চাকরির জন্যে এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াই, তখন আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ, আমাদের রাষ্ট্রটাই আমাদের অপমান করে ছাড়ে। আমাদের চেনা মানুষ, চেনা মুখগুলোই তখন আমাদের দিকে করুণার চোখে তাকায়। বলো অরিত্রী, এই অপমানের শোধ আমরা কিভাবে নিই?
সর্বোচ্চ রেজাল্ট করেও যখন আমার চাকরি মেলে না, কিন্তু আমার চেয়ে কম মেধাবী, কম যোগ্য কেউ যখন কোটা কিংবা ক্ষমতার বলে আমার পজিশানটাই দখল করে বসে, তখন নিজের প্রতি নিজের করুণা হওয়া ছাড়া আর কিইবা করতে পারি আমরা?
তোমার বাবার জন্যে খুব কষ্ট লাগলো। স্কুলের ওই শিক্ষক তোমার বাবাকে ডেকে ওইভাবে অপমান না করলেও পারতেন। কিন্তু অরিত্রী, আজকে যারা ঢাবিতে, চবিতে, রাবি আর জাবিতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, তাদের বাবার অপমানটা সম্পর্কে তুমি জানো কি? আমাদের মধ্যবিত্ত বাবারা রক্তবিন্দুর বিনিময়ে আমাদের ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করিয়েও যখন দেখে আমরা 'সুশিক্ষিত বেকার', তখন তারাও অপমানিত হয়। লজ্জিত হয়।
অরিত্রী,
তোমার সাথে রাজু আর হুজাইফাদের মূল পার্থক্য হলো- সমাজ আর রাষ্ট্র তোমাকে মূল্যায়ন করে, রাজু আর হুজাইফাদের করেনা।
তোমার সাথে তাদের পার্থক্য হলো এই- তোমার চলে যাওয়াতে আমরা কাঁদি। শোকে ভেঙে পড়ি। আওয়াজ তুলি। বিচার দাবি করি তোমার অপমানের, কিন্তু রাজু আর হুজাইফাদের জন্য আমরা কাঁদিনা। তাদের মৃত্যু নিয়ে আমরা কথা বলিনা। তাদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে আমরা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক গরম করিনা।
তোমার অপমানটা আমাদের গায়ে লাগে, রাজুদের অপমান আমাদের গায়ে লাগেনা। তোমার বাবার অপমানকে আমরা বড়ো করে দেখি, কিন্তু হুজাইফাদের বাবার অপমান আমরা চোখেই দেখিনা। কারণ কি জানো? কারণ হলো- তুমি মরেছো কেবল সেদিন। কিন্তু, রাজু আর হুজাইফারা তো সেদিনই মরে গেছে যেদিন থেকে এই রাষ্ট্রে পঁচন ধরেছে। আমরা তোমার জন্যে কথা বলছি কারণ তোমরা এলিট শ্রেণীর মানুষ। ভুখা-নাঙা শ্রেণীর রাজুদের মৃত্যু নিয়ে কথা বলার সময় আমাদের কই, বলো?
অরিত্রীর প্রতি আরিফ আজাদের চিঠি
Reviewed by bd
on
23:00
Rating:
No comments: