দিনের সূর্যটা তার চিরাচরিত নিয়মে দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছে। পাখিরা দলবেঁধে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের নীড়ে। পৃথিবী আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের অতল গহ্বরে। একটু পরেই আযান হবে। মিনার থেকে ভেসে আসবে মুয়াজ্জিনের সকরুণ সুর। এই সুর প্রতিধ্বনিত হবে মসজিদে নববীর প্রতিটি দেয়ালে।
আজকেই রামাদানের শেষ দিন। অশেষ রহমতের মাসের শেষ সূর্যটা ইতোমধ্যে অস্ত চলে গেছে। অপেক্ষা আর কেবল খানিকটা সময়ের। মুয়াজ্জিনের আযান হলেই পরিসমাপ্তি ঘটবে রামাদান মাসের।
আজকেই রামাদানের শেষ দিন। অশেষ রহমতের মাসের শেষ সূর্যটা ইতোমধ্যে অস্ত চলে গেছে। অপেক্ষা আর কেবল খানিকটা সময়ের। মুয়াজ্জিনের আযান হলেই পরিসমাপ্তি ঘটবে রামাদান মাসের।
মসজিদে নববীর বারান্দার এক কোণে বসে আছে একজন মুসল্লী। চেহারায় উদাসীনতার ছাপ। চোখ ছলছল। আগামীকাল ঈদ হবে। শহরজুড়ে থাকবে খুশির জোয়ার। মানুষের হৃদয়ে বইবে আনন্দের প্লাবন। কথা ছিলো, লোকটিও ঈদের খুশিতে মাতোয়ারা হবে। আনন্দে আত্মহারা হবে তার দেহ-মন। কিন্তু, তার হৃদয়ের ভিতরে বিচ্ছেদের অন্তর্দহন। প্রিয় বস্তুকে হারিয়ে ফেলার পরে হৃদয় যেভাবে হাহাকার করে উঠে, প্রিয়তমার বিয়োগে যেমন করে কেঁপে উঠে প্রেমিকের মন- ঠিক সেভাবে লোকটির হৃদয় গভীরেও এক কঠিন বিচ্ছেদ বিয়োগের উথাল-পাতাল অবস্থা।
মুয়াজ্জিন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে গলা ছাড়ার সাথে সাথে লোকটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য! শেষ ইফতার আজ। মুখে কোনোভাবে একটা খেঁজুর গুজে দিয়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে লোকটি। পারছেনা। বুকের কোথায় যেন লুকিয়ে থাকা সব আবেগ, সব কান্না আজ বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো ছুটে আসছে। এই কান্না যেন থামবার নয়। এই আঁখিজল যেন ফুরোবার নয়। কোন সে কষ্ট যা তাকে এমন খুশির মুহুর্তেও বিষাদে জর্জরিত করে দিচ্ছে? কোন সে বিয়োগ-ব্যথা যা তার হৃদয়কে করছে ক্ষত-বিক্ষত? কোন সে জিনিস যা হারিয়ে ফেলার শোকে আজ শোকাতুর তার অন্তর?
লোকটা কাঁদছে, কারণ- আজ রামাদান শেষ হয়ে গেলো। গুণে গুণে ত্রিশটা দিন চলে গেলো চোখের পলকে। এই মাসে অবিরাম রহমত বর্ষণ হয়। অথচ, রহমত পাওয়ার মতোন কোন আমল কি সে করেছে? করলেও তা কি আল্লাহর সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা কবুল করেছেন? এই মাসে অসংখ্য পাপী বান্দাদের মাফ করে দেওয়া হয় যারা আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে মাফ চায়। মাফ পেয়ে যাওয়া সেই বান্দাদের তালিকায় কি তার নাম উঠেছে? যদি না উঠে, তাহলে পরেরবার উঠানোর সুযোগ কি সে পাবে? রামাদান মাস নিজেকে পরিশুদ্ধ, নিজের গুনাহগুলো ধুয়েমুছে নেওয়ার সবচেয়ে সেরা মাস। এই সেরা মাসটি আজ বিদেয় নিচ্ছে। সে কি পেরেছে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে? নিজের বিগত দিনের পাপগুলো, গুনাহগুলো, অন্যায়গুলোকে ধুয়েমুছে দিতে? এমন অপরাধবোধ, এমন ভয় ভয় চিন্তা থেকেই লোকটি কাঁদছে...
ঘটনাটি পড়েছিলাম একটি ইংরেজি ম্যাগাজিনে। লোকটির জায়গায় নিজেকে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। চিন্তা করলাম- জীবনের কতোগুলো রামাদান আমি পশ্চাতে ফেলে এসেছি। প্রতিটি রামাদান ছিলো আমার জন্য একেকটি সুযোগ। পাপ আর পঙ্কিলতার গহ্বর থেকে নিজেকে মুক্ত করার সুবর্ণ সেই সুযোগগুলোর কতো যাচ্ছেতাই ব্যবহারই না আমি করেছি।
আমাদের রামাদানগুলোর অর্ধেক সময় ঘুমের মধ্যেই কেটে যায়। বাকি অর্ধেক কেটে যায় ইফতারি আর সেহেরির বাহারি আয়োজন এবং ঈদের শপিং করতে করতে। জীবনের এই যে এতোগুলো রামাদান পার করে এলাম, কোন এক রামাদানের জন্য কি আমার একটিবারের জন্যও মন খারাপ হয়েছে? দুঃখবোধ হয়েছে? কান্না পেয়েছে? পাপ মোচন করাতে পেরেছি কি না- এই অনুশোচনাবোধ থেকে কখনো কি আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি? মনে পড়েনা।
রামাদান আমাদের কাছে অন্য দশটা সাধারণ মাসের মতোই। রামাদানেও আমরা ফুটবলের জমজমাট ম্যাচ উপভোগ করি। আইপিএল-বিপিএল কোনোটাই বাদ যায় না। রামাদানেও মিথ্যা কথা বলি, লোক ঠকাই, মানুষকে ধোঁকা দিই, মানুষের হক নষ্ট করি, অন্যকে কষ্ট দিয়ে বেড়াই, গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের সাথে সারারাত ধরে চ্যাট করি, ফোনালাপ করি।
রামাদান আমাদের মাঝে যে বিশাল রহমত আর মাগফিরাতের ডালা নিয়ে আসে, তার কতোটুকু আমরা কুড়িয়ে নিতে পারি? এই মাস হলো কুরআন নাযিলের মাস। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা, যিনি সমগ্র আসমান-যমীনের রব, মালিক- তিনি অনুগ্রহ করে আমাদের জন্য একটি জীবনবিধান নাযিল করেছেন এই মাসেই। সারা বিশ্বজাহানের যিনি প্রভু, তিনি আমার জন্য তাঁর কথা, তাঁর বাণী সবচেয়ে সম্মানিত ফেরেশতার মাধ্যমে, সবচেয়ে সম্মানীত নবীর কাছে পাঠিয়েছেন- এই ব্যাপারটা আমাকে কি একেবারেই রোমাঞ্চিত, বিমোহিত করে না? অথচ, কোথাকার কোন সেলেব্রেটির সাথে কোনদিন আমার দেখা হয়েছে, সেটা ডায়েরিতে টুকে রাখি, ফেইসবুকে চেক ইন দিয়ে রাখি। যে মাসটাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, সেই মাসে কুরআনের সাথে আমার সম্পর্ক কতোটুকু হয়?
রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভয় জাগানিয়া একটি হাদীস আছে। যতোবার এই হাদীসটা আমার সামনে আসে, ততোবারই আমি ভিতর থেকে কুঁকড়ে যাই। হাদীসটা এরকম-
একবার রাসূল সাল্লাল্ললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার সাথে সাথে বললেন, ‘আমীন’। এরপর দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন এবং বললেন, ‘আমীন’। তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখার সাথে সাথে বললেন, ‘আমীন’। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলো, ‘হে আল্লাহর রাসূল। আপনাকে তিন তিনবার আমীন বলতে শুনলাম। ইতোপূর্বে আপনাকে আর এরকম বলতে শুনিনি আমরা’। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন জিবরাঈল বললো, ‘ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যে রামাদান মাস পেলো অথচ নিজের গুনাহুগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারলো না’। জিবরাঈলের এই কথা শুনে আমি বললাম, ‘আমীন’। এরপর জিবরাঈল আবার বললো, ‘ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি, যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হলো কিন্তু সে আপনার উপর দরূদ পাঠ করলো না’। আমি বললাম, ‘আমীন’। এরপর জিবরাঈল আবার বললো, ‘ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি, যে বাবা-মা দুইজনকে, অথবা যেকোন একজনকে জীবিত অবস্থায় পেয়েও (তাদের সেবা করে) জান্নাত লাভ করতে পারলো না’। আমি বললাম, ‘আমীন’।
চিন্তা করুন, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম হলেন ফেরেশতাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানীত, উঁচু পর্যায়ের ফেরেশতা যাকে দিয়ে আল্লাহতায়ালা নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ওহী পাঠিয়েছেন। সেই জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাদের জন্য বদদোয়া করছেন যারা রামাদান মাস পেয়েও নিজের গুনাহগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারেনা। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, সেই বদদোয়াতে ‘আমীন’ বলেছেন স্বয়ং রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাহলে, এই বদদোয়া বিফলে যাওয়ার কি বিন্দু পরিমাণও সুযোগ আছে? নেই। তার মানে, রামাদান মাস হলো ‘উইন অর লস’ এর মাস। হয় জেতো, নয় হারো। এই দুটো ছাড়া আর কোন অপশন খোলা নেই।
আমি এমন অনেককেই চিনি যারা গত রামাদানে বেঁচে ছিলো, কিন্তু এই রামাদানে তারা কবরের বাসিন্দা। এমন অনেক মহিলাই এখন কবরে শায়িত আছে যারা গত বছরের রামাদানের সময়গুলো শপিংমলে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিয়েছে। এমন অনেক মহিলাই এখন অন্ধকার কবরের অধিবাসী হয়ে আছে যারা গতবছর রামাদানের সময়গুলো টিভি সিরিয়াল দেখতে দেখতে পার করেছে।
এমন অনেক যুবক আছে যারা গতবছর রামাদানের রাতগুলো ফুটবল ম্যাচ, ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে দেখতে পার করেছে, কিন্তু আসন্ন রামাদানের আগেই তারা দুনিয়ার পাঠ চুকিয়ে চলে গেছে ওপারে।
এমন অনেক যুবক আছে যারা গতবছর রামাদানের রাতগুলো ফুটবল ম্যাচ, ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে দেখতে পার করেছে, কিন্তু আসন্ন রামাদানের আগেই তারা দুনিয়ার পাঠ চুকিয়ে চলে গেছে ওপারে।
তারা চাইলেও আর কখনো রামাদান মাস পাবেনা। কখনো চাইলেও রামাদানের একটি রাতে কুরআন তিলাওয়াত করার সুযোগ পাবেনা। রামাদানের কোন এক রাতে দুই রাক’আত কিয়ামুল লাইল পড়ার সুযোগ আর কোনোদিন তাদের দেওয়া হবেনা। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে ক্ষত-বিক্ষত হলেও একটিবারের জন্যও তাদেরকে আর লাইলাতুল কদ্বরের রাতে সালাত পড়ার, কুরআন তিলাওয়াত করার, যিকির করার সুযোগ দেওয়া হবেনা। কোন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে দেওয়া হবেনা তার অপরিশোধিত যাকাত আদায় করে যাওয়ার সুযোগ। কোন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিকে দেওয়া হবেনা তার মিস করে যাওয়া সিয়ামগুলো পালন করে যাওয়ার সুযোগ। নিদেনপক্ষে, তাওবাটুকু করে যাওয়ার সুযোগটাও কাউকে আর দেওয়া হবেনা। কারণ, সময় ফুরিয়ে গেছে...
আজ আমরা যারা বেঁচে আছি, এই রামাদানটাই হতে পারে আমাদের জীবনের শেষ রামাদান। হতে পারে এটাই আমাদের জীবনে আসা শেষ সুযোগ। হতে পারে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া এটাই আমাদের জন্য শেষ সময়। যদি এই রামাদান আমাদের জীবনের শেষ রামাদান হয়, তাহলে এই রামাদান ঠিক কিভাবে কাটানো উচিত? রামাদানের একটা মাসকে কিভাবে মূল্যায়ণ করা উচিত? ফরয সালাত, সিয়াম, কিয়ামুল লাইল, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সাদাকা, যাকাত-ফিতরা- সবকিছু ঠিক কিভাবে করা উচিত? জীবনের শেষ সুযোগটুকু কি আমরা কাজে লাগাবো না? যদি ব্যর্থ হই, তাহলে কি হবে? তাহলে আফসোস করে বলতে হবে-
‘হায়! যদি আমি আখিরাতের জন্য কিছু আমল করতাম’- সূরা আল ফাজরঃ ২৪।
/ আরিফ আজাদ
'যদি হয় জীবনের শেষ রামাদান'
Reviewed by bd
on
03:43
Rating:
No comments: