‘রামাদানের আগে’


দরজায় কড়া নাড়ছে রামাদান। আর কয়েকটা দিন বাদেই বাঁকা চাঁদের আলতো হাসিতে পৃথিবী বরণ করে নেবে বছরের সেরা মাসটিকে। এই মাস রহমতের। এই মাস বরকত এবং নাযাতের। মাসটা সেরা হয়ে আছে, কারণ- এই মাসেই নাযিল হয়েছে পবিত্র আল কুরআন। মানবজাতির হেদায়াতের জন্য সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। আল্লাহর কথা। আল্লাহর বাণী। এই কুরআন অনন্য। এই কুরআন অনিন্দ্য। এই কুরআন অভিনব। পৃথিবীবাসী কুরআনের মতোন আগে না কিছু দেখেছে, না পরে কিছু দেখবে।
রামাদান মাস। এই মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের প্রশস্ত দরজাগুলো। সেই দরজা দিয়ে আগত জান্নাতী খুশবুতে মৌ মৌ করে চারদিক। এই সেই মাস, যে মাসে শিকল পরিয়ে দেওয়া হয় অভিশপ্ত শয়তানের পায়ে।
এই মাসে লুকায়িত আছে একটি রাত। একটি রজনী। এমন এক রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। যদি কোন এক আল্লাহর বান্দা সেই রাতে আল্লাহর কাছ থেকে প্রকৃত ক্ষমা চেয়ে নিতে পারে, তার প্রয়োজন মিটিয়ে নিতে পারে, তার আশা-আকাঙ্খার কথা মনখুলে তার রবকে বলে নিতে পারে, তার দুঃখবোধ জানিয়ে দিতে পারে, তার মনোঃবেদনা ব্যক্ত করতে পারে- তাহলে ধরণীর বুকে কে এমন আছে যে তার চেয়ে উত্তম হতে পারে?
রামাদান মাস আল্লাহর কাছে কতোটা প্রিয় তা বর্ণনা করতে গিয়ে সুন্দর একটি উপমা দিয়েছেন ইবনুল জাওযী রাহিমাহুল্লাহ। তিনি বলেছেন, ‘বছরের বারো মাস হলো ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বারোজন পুত্রের মতো। এই বারোজনের মধ্যে ইউসুফ আলাইহিস সালাম যেমন পিতা ইয়াকুবের কাছে সবচাইতে প্রিয় ছিলেন, ঠিক সেভাবে বারো মাসের মধ্যে রামাদান মাস হলো আল্লাহর কাছে সবচাইতে প্রিয় মাস। ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বারোজন পুত্রের মধ্যে ইউসুফ আলাইহিস সালামের দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ যেভাবে বাকি এগারোজনকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে বারো মাসের মধ্যে রামাদান মাসের দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের গুনাহও ক্ষমা করে দেন’।
সুবহানআল্লাহ! কতোই না সুন্দর উপমা! ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বারোজন পুত্রের মধ্যে এগারোজন ছিলো ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। সেই ঈর্ষার বশঃবর্তী হয়ে তারা একদিন শিশু ইউসুফকে কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করে এবং তাদের পিতার কাছে এসে মিথ্যে কথা বলে। তারা একটি মিথ্যাকে রঙচঙ মাখিয়ে ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে উপস্থাপন করেছিলো। বলেছিলো- ইউসুফকে নাকি বাঘে খেয়ে ফেলেছে!
নিজেদের সহোদর ভাইকে কূপে নিক্ষেপ করে হত্যা করার মতোন ঘৃণ্য চেষ্টা, জঘন্য অপরাধকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা ক্ষমা করে দিয়েছিলেন কেবল ইউসুফ আলাইহিস সালামের দোয়াতে। ঠিক একইভাবে, সারা বছরজুড়ে আমরা কতো ঘৃণ্য, জঘন্য অপরাধ করি, তাইনা? চোখের যিনা, হাতের যিনা, মুখের জিনা, জিহ্বার যিনা, পায়ের যিনা করে থাকি। সারারাত ইন্টারনেটের নিষিদ্ধ সাইটগুলোতে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকি। বাবা-মা’র সাথে অসভ্য আচরণ করি। মানুষের সাথে দূর্ব্যবহার করি। তাদের হক নষ্ট করি। ঠকাই। সালাত পড়িনা। মিথ্যে কথা বলি। আরো অনেক...অনেক...
এই যে এক মহাসমুদ্র পরিমাণ পাপ এবং পঙ্খিলতার মাঝে নিত্য হাঁবুডুঁবু খাচ্ছি- আমরা চাইলে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারি। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগের নাম হলো ‘রামাদান’। অন্ধকার গহ্বর থেকে উঠে আসার একটি একটি সিঁড়ির নাম হলো ‘রামাদান’। ইউসুফ আলাইহিস সালামের দোয়ার ফলে যেমন করে ওই এগারোজনকে আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন, আমরা আশা করি, ইন শা আল্লাহ, রামাদান মাসে আমাদের চেষ্টা,-তদবির, আমাদের আন্তরিকতা, রাতের শেষ সময়গুলোতে আমাদের চোখের জলের বদৌলতে আমরাও আল্লাহর কাছে ক্ষমা পেয়ে যাবো।
প্রিয় কোন মানুষ যখন অতিথি হয়ে আমাদের বাসায় আসেন, আমরা চেষ্টা করি তিনি আসার আগেই আমাদের ঘরটাকে একটু পরিপাটি করে রাখতে। একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে। আমরা টেবিলে ফলমূল সাজাই। ফুলদানিতে ফুল দিয়ে রাখি। তিনি যেখানে থাকবেন সেখানটায় পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করি। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি তিনি কি খাবেন আর কি খাবেন না সেই লিস্ট তৈরিতে। তিনি যা খেতে পছন্দ করেন তা জোগাড় করতে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করি। আর, বিদায় বেলায় খুব বিনয়ের সাথে বলি, ‘আসলে, আপনি আসলেন অথচ আপনার জন্য তেমন কিছুই করতে পারলাম না’।
আমরা এসব কেনো করি? কারণ- আমরা তাকে বোঝাতে চাই যে আমাদের জীবনে তিনি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাকে অনুধাবন করাতে চাই যে, তিনি আমাদের কতোটা প্রিয়, কতোটা কাছের। আমরা তাকে এই বার্তাটুকু দিতে চাই যে- তাকে আমরা ভালোবাসি। সত্যি সত্যিই ভালোবাসি।
রামাদান মাসও আমাদের কাছে সেই পরম প্রিয় অতিথির মতো। এই অতিথি কখনও খালি হাতে আমাদের কাছে আসেন না। বারাকাহ, রহমত, নাজাত আর মাগফিরাতের ডালা নিয়ে আসেন। এই মাস আমাদের কাছে অধিক প্রিয়, কারণ- এই মাসেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা অনুগ্রহ করে তার বাণী, তার কথামালা আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া চিঠির তারিখ যেমন আমরা সযত্নে টুকে রাখি, প্রিয় মানুষের সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিনক্ষণ যেভাবে আমরা স্মৃতিপটে পরম মমতায় ধারণ করি, ঠিক সেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার কাছ থেকে প্রথম যেদিন, যে মাসে তার বাণী আমাদের কাছে এসেছে, সেই দিন, সেই মাসটাও আমাদের কাছে পরম শ্রদ্ধার, ভালোবাসার, ভালোলাগার।
কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো এই- প্রিয় অতিথির জন্য যেভাবে আমরা সাজিয়ে রাখি আমাদের বাড়িঘর, সেভাবে কি প্রিয় রামাদান আসার পূর্বেই আমরা সাজিয়ে নিই আমাদের মনের উঠোন? অন্তরে জমে থাকা পাপ, বিদ্বেষ আর গুনাহের আবরণ ছেড়ে আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত হই অতিথি ‘রামাদান’-কে বরণ করার জন্য? হৃদয়ের গভীর থেকে কখনো কি আমরা রামাদানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করি?
যা যাবার তা গেছে। সামনে আসন্ন ‘রামাদান’ নামক অতিথির জন্য আমরা কি আজকে থেকেই প্রস্তুত হতে পারিনা? আমরা কি সত্যি সত্যিই চাইনা যে আমাদের পরম আরাধ্য অতিথি এসে আমাদেরকে একটু প্রস্তুত অবস্থায় দেখুক? আমরা কি চাইনা যে আমাদের অতিথি এসে দেখুক আমরা তার আগমনের পূর্বেই মিথ্যে বলা থেকে নিজেকে নিবৃত করে ফেলেছি? আমরা কি চাইনা যে আমাদের প্রিয় অতিথি এসে দেখুক তার আগমের পূর্ব থেকেই আমরা অশ্লীল কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি? অশ্লীল কাজ করা ছেড়ে দিয়েছি? অশ্লীল জিনিস দেখা ছেড়ে দিয়েছি?
কেমন হবে যখন আমাদের অতিথি এসে দেখবে যে আমরা তার আগমনের আগেই তাহাজ্জুদ সালাতে নিয়মিত হয়ে গেছি? তার আগমের পূর্বেই দাঁড়ি রাখতে শুরু করেছি, টাখনুর উপরে কাপড় পরতে শুরু করেছি, হিজাব-নিক্বাব করতে শুরু করেছি, মাহরাম-নন মাহরাম মেনে চলতে শুরু করেছি, ধূমপান ছেড়ে দিয়েছি...
রামাদান মাস হলো সূর্যের মতো। সূর্যের আলো পেয়ে বীজে যেমন অঙ্কুরোদগম হয়, ঠিক সেভাবে রামাদানের ছোঁয়াতে আমাদের অন্তর আরো বেশি পরিশুদ্ধ, আরো বেশি শীতল হতে শুরু করে। তবে, অঙ্কুরোদগমের প্রথম শর্ত কিন্তু বীজ রোপন করা। বীজবিহীন খালি জমিতে অঙ্কুরোদগম হতে পারেনা। তেমনিভাবে, রামাদান আসার পূর্বেই যদি নিজেদের অন্তরকে পাপের সাগর থেকে টেনে না তুলতে পারি, রামাদান কিন্তু সেই অন্তরে হেদায়াতের অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারবেনা। তাই, আর দেরি নয়। আজ থেকেই শুরু হোক প্রস্তুতি। প্রিয় অতিথিকে বরণ করে নেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হোক এই মুহূর্ত থেকেই...
‘রামাদানের আগে’/ আরিফ আজাদ
‘রামাদানের আগে’ ‘রামাদানের আগে’ Reviewed by bd on 03:45 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.